স্বদেশ ডেস্ক:
এমএলএম (মাল্টি লেভেল কোম্পানি) ব্যবসার নামে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। শুরু হয়েছিল ১ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা আত্মসাতে ‘ইউনিপে টু ইউ’র মাধ্যমে। ঘটনা ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৭ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক জোগাড় করে। ২ লাখ ১২ হাজার টাকা দিয়ে স্বর্ণের বার কিনে ১০ মাসে ১০-১২ লাখ টাকা আয় করার প্রলোভন দেখিয়ে ইউনিপে টু ইউ ওই গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। ওই অর্থের দ্বিগুণ ২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। জরিমানার এ অর্থদ-ের পুরোটাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের শনাক্তক্রমে দেওয়ার বিষয়ে রায় দেন আদালত। আড়াই বছর আগে ঘোষিত ওই রায় এত দিনেও আলোর মুখ দেখেনি। রায়ে বলা হয়েছে, আদালতের পক্ষে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের (ইউনিপে টু ইউ-তে বিনিয়োগকারী) তালিকা নির্ণয় সম্ভব নয়। ফলে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তি নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এহসান গ্রুপ, ধামাকাসহ বেশ কয়েকটি এমএলএম ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সামনে আসায় একটি প্রশ্ন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। সেটি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগ করা বা পণ্য কেনার জন্য প্রদত্ত অর্থ পাবেন কিনা? এ নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের দুই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। কেউ বলেছেন, টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কারণ সে ধরনের আইন বিদ্যমান না থাকায় গ্রাহকরা মাথা ঠুকে মরলেও টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অতিমুনাফার লোভ দেখিয়ে এমএলএম ও ই-কমার্সের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, সেই টাকা কোম্পানির ফান্ডেও নেই। যেমন বলা চলে ইভ্যালি একটি পণ্য কিনলে একটি ফ্রি দেওয়ার নামে গ্রাহকের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের ব্যাংক হিসাবে রয়েছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। তেমনি ই-অরেঞ্জের হিসাবেও কোনো টাকা নেই। এমনকি র্যাবের কাছে দেওয়া তথ্য মতে, এহসান গ্রুপ গ্রাহকের কাছ থেকে যে ১৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে, সেই টাকারও কোনো হদিস নেই। গ্রাহক এই টাকা আদৌ পাবেন কিনা, কোনো পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে কোনো ধরনের আশ্বাস পাচ্ছেন না।
ডেসটিনির ৪৫ লাখ গ্রাহকের বেলায়ও এমনটি ঘটেছে। ইভ্যালির হাজার হাজার গ্রাহক এখন রাস্তায়। তারা মাথা চাপড়াচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় গ্রাহকের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো উপায় আছে কিনা সে বিষয়টি কাজ করতে গিয়ে আমাদের সময়ের হাতে আসে ইউনিপে টু ইউর আলোচিত সেই রায়। ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন রায় প্রদান করেন। রায়ে ইউনিপে টু ইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনতাসির হোসেন (বর্তমানে কারাগারে), চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান (পলাতক), পরিচালক মাসুদুর রহমান (পলাতক), মঞ্জুর এহসান চৌধুরী (পলাতক), এম জামশেদ রহমান (জেলে) এবং এইচএম আরশাদউল্লাহকে (বর্তমানে জেলে) ২০০৯ ও ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ১২ বছর করে সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। এ ছাড়া গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের দ্বিগুণ ২ হাজার ৭০২ কোটি ৪১ লাখ ১১ হাজার ৭শ ৮৪ টাকা অর্থদ- করা হয়। রায়ে বলা হয়, অর্থদ-ের সমুদয় অর্থ রাষ্ট্র পাবে এবং সেই টাকা রাষ্ট্রকে গ্রাহকদের দিতে হবে। রায়ে বলা হয় ইউনিপে টু ইউর তিনটি হিসাবে জব্দ রয়েছে ৪২০ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৩ টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের লাখ লাখ জনসাধারণের আমানতের একটি ক্ষুদ্র অংশ এই জব্দকৃত টাকা। ওই টাকা সঠিক তালিকা প্রস্তুত করে গ্রাহককে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে রায় ও পর্যবেক্ষণে তাগিদ দেন আদালত।
প্রসঙ্গত, ইউনিপে টু ইউ মালয়েশিয়ার বেস্ট জিনিয়াস এজেন্ট হিসেবে অনলাইনে প্রচার চালিয়ে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে। তখনো অনলাইন ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয় কোম্পানিটি। ক্ষেত্রেবিশেষে ১০০% ও ২০০% মুনাফা প্রদানের আশ^াস দিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। যে স্বর্ণ ব্যবসার কথা বলে তারা গ্রাহককে বিভ্রান্ত করে সেই স্বর্ণ বাস্তবে ভল্টে রাখার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এ রকম স্বর্ণ ক্রয়ের বিষয়টি কোম্পানির ম্যানুফ্যাকচার অব আর্টিকেলেও উল্লেখ নেই। স্বর্ণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকেরও অনুমতি নেই। অর্থাৎ স্বর্ণেরই কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া বিদেশি এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করারও কোনো বৈধতা ছিল না প্রতিষ্ঠানটির।
প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্র্যাক ব্যাংক এলিফ্যান্ট রোড শাখা, সিটি ব্যাংক নিউমার্কেট শাখা এবং এনসিসি ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় লেনদেন করে ইউনিপে টু ইউ। গ্রাহকের খোলা ৬৩৪টি হিসাবে জমা টাকার পুরোটাই ওই তিন হিসাবে স্থানান্তর করে কোম্পানি। গ্রাহককে স্বর্ণের পাহাড় কেনারও স্বপ্ন দেখানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ১০ মাসের প্যাকেজের বিপরীতে ২৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয় গ্রাহককে। যেটি করেছে এহসান গ্রুপ, ই-অরেঞ্জ ও ধামাকাসহ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক তৌহিদুল ইসলাম জানান, ইউনিপে টু ইউর মুনাফা প্রদানের বিষয়টি কল্পনাপ্রসূত ছিল। এ ছাড়া তা বাস্তবসম্মতও ছিল না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ভার্চুয়ালি স্বর্ণ বিক্রির কথা বলেও টাকা হাতিয়ে নেয়। স্বর্ণের ছোট বারে ২৫-৩২ শতাংশ মুনাফা পাওয়ার লোভ দেখানো হয়। জানা গেছে, প্রতারিত গ্রাহকরা ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টাকার জন্য আইন-আদালত এবং বিভিন্ন দপ্তরের পেছনে ঘুরছে। কেউ কেউ টাকা ফেরত চেয়ে রিটও করেছে। গ্রাহকদের একটি ফোরামও তৈরি হয়েছে এরই মধ্যে। তাদের একজন আকরাম হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, রাষ্ট্র চাইলে আমাদের দায়িত্ব নিতে পারে। আদালতের রায়ও সে রকম। তিনি ধারণা দিয়ে বলেন, জব্দ করা টাকা থেকে চাইলে আমাদের পাওনা পর্যায়ক্রমে দিতে পারে। কিন্তু কেউ সে দায়িত্ব নিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউনিপে টু ইউর চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান, পরিচালক মাসুদুর রহমান ও মঞ্জুর এহসান চৌধুরী বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। গ্রাহকের টাকা নিয়ে সেখানে তারা গড়েছেন সেকেন্ড হোম। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
ইউনিপে টু ইউ যে কায়দায় গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে প্রায় একই কায়দায় গত কয়েক বছরের গজিয়ে ওঠা এমএলএম ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও তা করেছে।
এদিকে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে দুদকের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান আমাদের সময়কে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে সম্পত্তি অবরুদ্ধ রাখা হয়। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আদালতে যাবেন; দুই পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে আদালত চাইলে টাকা ফেরত দিতে পারেন। ইউনিপে টু ইউর মামলায় যারা সাজা পেয়েছেন এবং জেলে রয়েছেন তারা আপিল করেছেন। আপিলের রায় পর্যন্ত গ্রাহককে অপেক্ষা করতে হবে। বিচারিক আদালতের রায় বহাল থাকলে বা নিশ্চিত হলে গ্রাহককে টাকা দেওয়ার একটা রাস্তা বের হতে পারে।